সফল ফ্রিল্যান্সার, উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর জন্য ফ্রিল্যান্সিং অধুনা বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এইরকম মানুষের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে যারা ফ্রিল্যান্সিংকে তাদের জীবিকা হিসেবে নিচ্ছেন। প্রতিযোগিতাও বেড়েই চলেছে আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডটকম, ফাইভার প্রভৃতি মার্কেটপ্লেসগুলোতে। বাংলাদেশেও গড়ে উঠে গিয়েছে স্থানীয় মার্কেটপ্লেস বিল্যান্সার। এ পর্যায়ে এইখানে সফলতা লাভ করার জন্য আপনাকে অবশ্যই অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে হবে। তবুও কীভাবে? আজ আমরা সাকসেস ফ্রিল্যান্সার হওয়ার কিছু মুল পয়েন্ট আলোচনা করব।
১। নিজের সম্মন্ধে জানা
আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রি বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে মূলত তিন প্রকারের মানুষ নোটিশ যায়। প্রথম ধরণের মানুষ ফুল টাইম ফ্রিল্যান্সিং করে। এরা মূলত পেশাদার যারা কিনা ডেস্ক চাকরি পছন্দ করেন না। দ্বিতীয় ধরণের পার্টটাইম ফ্রিল্যান্সিং করে থাকেন। এরা নির্দিষ্ট পরিমাণ অথচ প্রত্যহ কাজ করে থাকেন। আর তৃতীয় ধরণের মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। এনারা ভাবনা করেন কোন ধরনের কাজ করা ঠিক হবে, পূর্ণ সময় নাকি পার্টটাইম কাজ করবেন, এমনকি আদৌ ফ্রিল্যান্সিং করবেন কিনা এরকম দ্বিধায়ও ভুগে থাকেন। এধরণের ব্যক্তি আসলেই বিপদজনক অবস্থায় আছেন।
আপনাকে তৃতীয় প্রকারভেদ টিম থেকে বের হয়ে আসতে হলে প্রথমে নিজের যোগ্যতা, যে বিষয় আপনার উৎসাহ আছে তা, আপনার দুর্বলতা, আপনার নিজের সম্পর্কে সম্যক আন্দাজ রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাসী থেকে হবে তার সাথে টার্গেট সঠিক করার জন্য হবে। মূলত শক্ত সংকল্প নিয়ে আরম্ভ করলে বৈধ কোনো পেশাই মানুষের পক্ষে ইম্পসিবল নয়।
২। অপশন হাতে রাখা
আপনি হয়তো এইরকম অনেককেই পাবেন যারা একটি মাত্র টার্গেটের পিছনে আছেন তার সাথে সেটিকে তারা অর্জন করবেনই বলে কঠিন প্রতিজ্ঞ। ফ্রিল্যান্সিংয়ে এসে আপনি যদি এরূপ চিন্তা করে থাকেন কিন্তু আপনারও আরও বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ক্যারিয়ার কোন ‘মিশন’ না বরং এটা ‘ভিশন’এর থেকেও বড়। আশা করি ‘মিশন’ ও ‘ভিশন’ এর তফাৎ আপনি বোঝেন। মিশন হল স্বল্পমেয়াদি আর ভিশন হল মিশন এর হতে দীর্ঘমেয়াদি। যাইহোক, সবসময়ই ব্যাকআপ অপশন রাখা উচিৎ কেননা যেকোন একটি মার্কেটপ্লেস পক্ষান্তরে একজনমাত্র ক্লায়েন্টের উপর অবলম্বন করা উচিৎ নয়। হয়তোবা আপনার সাম্প্রতিক ক্লাইন্ট অনেক ভাল কিন্তু মনে রাখবেন তিনি চিরদিন থাকবেন না। আমাদের অভিজ্ঞতায় এরূপ লোকও দেখেছি যিনি কিনা শুধুমাত্র কাজের পারিশ্রমিক বারানোর কারণে তার ক্লাইন্ট হারিয়েছেন।
আসলে প্রতিযোগিতাপূর্ণ স্থানে রিস্ক ফ্যাক্টর প্রচণ্ড বেশি। এইখানে অনেক কিছুই থেকে পারে উদাহরণসরূপ আপনার প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ, মার্কেটপ্লেস অফ থেকে পারে, আপনার একাউন্টে সমস্যা থেকে পারে প্রভৃতি। আর এ কারণেই একের অধিক মার্কেটপ্লেস এর সঙ্গে কানেক্ট থাকুন, ক্লাইন্ট বাড়ান, নেটওয়ার্ক তৈরি করুন, নিজের পোর্টফলিও প্রোফাইল সৃষ্টি করুন।
৩। সময়ের সঠিক ব্যবহার
ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে সময় অধিক উৎকর্ষ মূল্যবান একটি সম্পদ। আপনার সময়কে সাজিয়ে গ্রহন করুন যাতে করে এর ঠিক ব্যবহার সম্ভব হয়। টাইম ট্র্যাকার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করুন। নোট নেয়ার জন্য এভারনোট, গুগল কিপ এর মত টুলস গুলোর হেল্প নিন। সময় মত ক্লাইন্ট এর কাজ সমাপ্ত করুন। সময়ানুবর্তিতা এবং দায়িত্বশীলতা ফ্রিল্যান্সিং এর ক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
৪। নির্ভুল কাজটি নির্বাচন করা
ফ্রিল্যান্সিং বাজারে প্রচুর কর্কশ লোকও রয়েছে। একারণে কাজ নেয়ার প্রথমে ক্লাইন্ট বিশ্বাসী কিনা তা ভালভাবে যাচাই করে নিন। পেমেন্ট মেথড ভেরিফাইড কিনা, ক্লাইন্ট এর রেটিং কিরকম আছে, ক্লাইন্ট এর ব্যাপারে অন্যদের রিভিউ কী বলে ইত্যাদি খেয়াল করুন। কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে ক্ল্যায়েন্ট পেমেন্ট নিয়ে লুকোচুরি খেললে সরাসরি ভাবে সাপোর্টে যোগাযোগ করুন।
৫। নিউ কয়েকটি শেখা
মৃত্যু পর্যন্ত নিজের দক্ষতাকে সামনের দিকে বাড়ানোর ক্ষেত্রে থাকে। জগতের সাথে আপডেট থাকা, স্কিল টেস্ট দেয়া, নিউ কম্যুনিটির সঙ্গে জয়েন হওয়া, আপনার চাকরি ফিল্ড এর সঙ্গে রিলেটেড নিউ বিষয়গুলো শেখা, কমিউনিকেশন এর নৈপুন্যতা বাড়ানো প্রভৃতি বিষয়গুলোর দিকে নজর দিন।
৬। নিজে নিজে শেখা
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সবথেকে জরুরি ব্যাপার হলো নিজে নিজে শেখা। কেননা আপনি স্বাভাবিক কোন চাকরি করলে ওই স্থান আপনাকে কাজে স্কিলফুল করে তুলতে বা কাজ শেখাতে নানা রকম কোর্স, ফ্রি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। তবুও একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজে নিজে শেখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। কাজেই নিজে নিজে শেখার বিষয়ে নৈপুন্যতা অর্জন করা খুবই জরুরি। নিজে থেকেই ঝোঁক নিয়ে নিউ বিষয় শিখে নিজের দক্ষতা বাড়ানো দরকার। নাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে।
তবে নিজে নিজে শেখার ক্ষেত্রে আরও একটি জরুরি ব্যাপার আপনি কী শিখছেন সেটি। অপ্রয়োজনীয় জিনিস শিখে নিজের সময় নষ্ট না করে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যেসব নৈপুন্যতা আপনার কাজে সাহায্য করার জন্য পারে সেগুলোর দিকে অভিনিবেশ দিন। একদম নতুন একটি জিনিস শেখার প্রথমে নিজে যা পারেন সেটিকে আরও পুষ্ট করার জন্য ট্রাই করুন। এক্ষেত্রে বই, অনলাইনে টিউটোরিয়াল, অন্য ফ্রিল্যান্সারদের নিকট হেল্প কাজে লাগাতে পারেন।
৭। লজিক্যাল রিজনিং
যে কোন কাজের ক্ষেত্রেই লজিক্যাল রিজনিং ১টি একান্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। যুক্তি দিয়ে যদি আপনি কোন কাজ কেন করছেন সেটা আপনার ক্লায়েন্টকে বোঝাতে না পারেন তবে ক্লায়েন্ট সহজেই আপনাকে ভ্রান্তি বুঝতে পারেন। অনেকসময় সঠিকভাবে বোঝাতে না পারার কারনে প্রচুর কাজ হারাতে হয় ফ্রিল্যান্সারদের। আর এজন্য লজিক্যাল রিজনিং পুষ্ট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাজ করতে করার জন্য এমন প্রচুর সময় আসবে যখন ক্লায়েন্ট আপনার নিকট জানতে চাইতে পারে যে আপনি এই কাজটি এভাবে কেন করেছেন। সেসময় সোজা ভাষায় যুক্তি সহকারে উপস্থাপন করার জন্য পারলে ক্লায়েন্টের আপনার প্রতি আস্থা বেড়ে যাবে এবং আরও কাজ পাবার চান্স সৃষ্টি হবে। কাজেই সঠিক যুক্তি দিয়ে ঠিক বর্ণনা দেওয়ার জন্য শিখে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফল হতে চাইলে।
৮। ফাস্ট স্মরণ করার ক্ষমতা
যে কোন কাজের জন্যই ফাস্ট স্মরণ ক্ষমতা খুবই কার্যকরী একটি দক্ষতা। ফ্রিল্যান্সিং কাজও তার ব্যতিক্রম নয়। আপনি যত ফাস্ট ধ্যান করার জন্য পারবেন তার সাথে আপনার কাজ সাজিয়ে ফেলতে পারবেন তত ফাস্ট কাজগুলো সমাপ্ত করার জন্য পারবেন। এটি আপনার কার্যক্ষমতা বহুগুনে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পারে।
দ্রুত কাজ সমাপ্ত করবার জন্য আপনি আপনার ক্লায়েন্টকে বাড়তি চার্জ করার জন্য পারেন। আপনি যত দ্রুত একটি কাজ সম্পন্ন করবেন আপনার ক্লায়েন্টের তত সময় বেঁচে যাবে। কাজেই দ্রুত কাজ করতে পারলে বাড়বে আপনার আয়ের পরিমাণও। কাজেই ফাস্ট ধ্যান করার ক্ষমতা অর্জন করুন।
৯। প্রবলেম সমাধানের দক্ষতা
সমস্যা সমাধানের নৈপুন্যতা আরেকটি ইম্পোর্টেন্ট ব্যাপার। ফ্রিল্যান্সিং কাজে অনেকসময়ই নানারকম রকম ঝামেলার সম্মুখিন হতে হবে আপনাকে। এই ঝামেলার সমাধান করার জন্য আর কারো উপর নির্ভর করার সুযোগ নেই। কাজেই নিজে নিজেই সকল ঝামেলার সমাধান বের করে ফেলতে হবে। সমস্যা সমাধানে আপনি যত এক্সপার্ট হবেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তত বেশি চাহিদা থাকবে আপনার। কাজেই নিজের সমস্যা সমাধানের দক্ষতার দিকে নজর দিন।
১০। সমালোচনা সহজভাবে গ্রহণ
সফল ফ্রিল্যান্সার হতে হলে মনে রাখবেন নিজেকে আরও উন্নত করবার ক্ষেত্রে নিজের সমালোচনা সঠিকভাবে গ্রহণ করার বিকল্প নেই। অনেকেই নিজের সমালোচনাকে পরিষ্কারভাবে নেন না। অথচ সমালোচনা থেকে আপনি নিজের ত্রুটি বুঝতে পারবেন তার সাথে কী করে এই ভ্রান্তি হতে বেরিয়ে আসা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে পারবেন। তবুও তাই নিজের সমালোচনা শোনার মানসিকতা থাকা জরুরি।
তবে সমালোচনা যদি গঠনমূলক হয় তবে সেই সমালোচনাই কেবল আপনাকে অগ্রগতি করার জন্য সাহায্য করবে। এছাড়া অন্য সকল প্রকারের সমালোচনাকে এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কাজেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সমালোচনার প্রকারভেদ বুঝে তাকে আলাদা করতে শিখুন এবং শেখান হতে নিজের অগ্রগতি করুন।
১১। অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেয়া
সফল ফ্রিল্যান্সার হতে হলে ,বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গেও সহজে মানিয়ে নেয়া শিখতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং কাজে সবসময়ই অনিশ্চয়তা থাকে। নোটিশ যায় কোন সময় খুবই ভালো কাজ পাওয়া যায় আবার প্রচুর সময় হাতে কোন কাজ থাকে না। এসব সময়ে হতাশ হয়ে কাজ ছেড়ে দিলে সফলতা পাওয়া দৃঢ় হয়ে যায়। আবার অনেকসময় অর্থনৈতিক মন্দা লক্ষ্য যায় সারা পৃথিবী জুড়েই। এসময় কাজ কম পাওয়া যায়। ফ্রিল্যান্সিং কাজের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন আয় থাকে না বলে এটা সবসময়ই কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। আর তাই এই সকল সমস্যার মাঝেও সফল হতে চাইলে মানিয়ে নেয়া শিখতে হবে। ইজিলি হতাশ না হয়ে ধৈর্যের সাথে দৃঢ় সিচুয়েশন মোকাবেলার দ্বারাই আপনি একজন সাকসেস ফ্রিল্যান্সার হতে পারবেন।
উপরের সকল বিষয়ে বাড়তি দৃষ্টি রেখে যদি আপনি নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন তবে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফল হওয়া সম্ভব। তবে আমাদের কান্ট্রিতে অধিকাংশই বৈদেশিক কারেন্সি আয়ের প্রলোভনে পড়ে ফ্রিল্যান্সিং ব্যাপারে কোনরকম ধারণা না রেখেই কাজ চালু করতে চান। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সময় বিকৃত হওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। কেননা ফ্রিল্যান্সিং অন্যান্য যে কোন কাজের মতই নৈপুন্যতা অর্জন করে আরম্ভ করতে হয়। সঠিক জ্ঞান না রেখেই ফ্রিল্যান্সিং করে উপার্জন করতে চাইলে সেখানে সফল হবার কোন সুযোগ নেই। কাজেই ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে জানুন, দক্ষতা অর্জন করুন। এরপর আপনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাহায্যে সাকসেস হওয়ার কল্পনা দেখতে পারেন।